সুরা ইয়া-সীন

বার্তাবাহকদের পরিচয়

তাফসীরে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এই বার্তাবাহকদের পরিচয় সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে:

১.         ইবনে কাসীরের দৃষ্টিভঙ্গি: “ইবনে ইসহাক সাইয়্যিদনা ইবনে আব্বাস, কা’ব আহবার এবং ওয়াহব ইবনে মুনাবেব থেকে বর্ণনা করেছেন যে এই শহরের কাছে প্রেরিত তিনজন প্রবীণ আল্লাহর নবী ছিলেন। এই বর্ণনায় তাদের নাম সাদিক, সাদুক এবং শালুম হিসাবে দেওয়া হয়েছে, যেখানে অন্য একটি বর্ণনায় তৃতীয়জনের নাম শামুন হিসাবে পাওয়া যায়” 1।

২.         বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি: “সাইয়্যিদনা কাতাদা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে مُّرْسَلُونَ (মুরসালুন: প্রেরিত ব্যক্তিগণ) শব্দটি এখানে এর কারিগরি অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, বরং এটি বার্তার বাহক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, এবং এই শহরে প্রেরিত তিনজন প্রবীণ নবী ছিলেন না, বরং সাইয়্যিদনা ঈসা (আঃ)-এর শিষ্যদের মধ্যে ছিলেন এবং তাঁর আদেশে এই শহরের পথ প্রদর্শনের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন” 1।

ইবনে কাসির প্রথম ব্যাখ্যাটিকে পছন্দ করেছেন যে তারা নবী ছিলেন, যেখানে “আল-কুরতুবি এবং অন্যান্যরা দ্বিতীয়টি গ্রহণ করেছেন। কুরআনের পাঠ্যের আপাত অর্থ থেকেও, সাধারণভাবে এটি বোঝা যায় যে এই সম্মানিত ব্যক্তিরা আল্লাহর নবী ছিলেন। আল্লাহ ভালো জানেন” 1।

এই পণ্ডিতী মতবিরোধ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে কুরআন গল্পের নীতি বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় বিবরণ সরবরাহ করলেও কিছু ঐতিহাসিক বিশেষত্ব ব্যাখ্যার বিষয় হতে পারে।

১৫-১৭ আয়াত: বার্তাবাহকদের দাবি এবং জনগণের প্রত্যাখ্যান

১৫-১৭ আয়াত: ﴿قَالُوا مَا أَنتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُنَا وَمَا أَنزَلَ الرَّحْمَنُ مِن شَيْءٍ إِنْ أَنتُمْ إِلَّا تَكْذِبُونَ . قَالُوا رَبُّنَا يَعْلَمُ إِنَّا إِلَيْكُمْ لَمُرْسَلُونَ . وَمَا عَلَيْنَا إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ﴾

অনুবাদ: “তারা বলল, ‘তোমরা তো আমাদের মত মানুষ, আর দয়াময় কিছুই অবতীর্ণ করেননি। তোমরা শুধু মিথ্যা বলছ।’ তারা [বার্তাবাহকগণ] বলল, ‘আমাদের রব জানেন যে আমরা তোমাদের কাছে প্রেরিত বার্তাবাহক, আর স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেওয়া ছাড়া আমাদের কোনো দায়িত্ব নেই।”

ভাষ্য: শহরবাসীর প্রত্যাখ্যান কুরআনে প্রায়শই দেখা যাওয়া একটি নিদর্শন অনুসরণ করে: বার্তাবাহকদের মানবতা উপর ভিত্তি করে অস্বীকার করা। তারা মানতে অস্বীকার করে যে আল্লাহ তাঁর বার্তাবাহক হিসেবে মানুষ নির্বাচন করবেন, পরিবর্তে ফেরেশতা দূত বা অসাধারণ ঘটনা প্রত্যাশা করেন। এটি মক্কাবাসীর নবী মুহাম্মদের প্রতি করা আপত্তির প্রতিচ্ছবি: “তারা বলে, ‘এ কেমন রাসূল যে খাদ্য গ্রহণ করে এবং বাজারে ঘুরে বেড়ায়?'” (কুরআন ২৫:৭)। তাদের প্রত্যাখ্যানের দ্বিতীয় অংশ – “দয়াময় কিছুই অবতীর্ণ করেননি” – সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাদেশ অস্বীকার করে, যা মানুষের সাথে ঐশ্বরিক যোগাযোগের ধারণার প্রতি সংশয়পূর্ণ মনোভাব।

বার্তাবাহকদের প্রতিক্রিয়া মার্জিত এবং তিনটি দিকের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ:

১.         ঐশ্বরিক জ্ঞানের প্রতি আবেদন: “আমাদের রব জানেন যে আমরা তোমাদের কাছে প্রেরিত বার্তাবাহক”

২.         তাদের মিশনের একটি নিশ্চিতকরণ: “আমরা তোমাদের কাছে প্রেরিত বার্তাবাহক”

৩.         তাদের দায়িত্বের একটি স্পষ্টীকরণ:””””আমরা স্পষ্ট বিজ্ঞপ্তি ছাড়া অন্য কোনো কিছুর জন্য দায়ী নই।”

এই শেষোক্ত বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি নবুয়তি কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রতিষ্ঠা করে: বার্তাবাহকগণ স্পষ্টভাবে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য দায়ী, কিন্তু এর গ্রহণ যোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য নয়। এই নীতিটি পরবর্তীতে নবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন হওয়ার সময় সান্ত্বনা জুগিয়েছিল।

১৮-১৯ আয়াত: হুমকির তীব্রতা বৃদ্ধি

১৮-১৯ আয়াত: ﴿قَالُوا إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ لَئِن لَّمْ تَنتَهُوا لَنَرْجُمَنَّكُمْ وَلَيَمَسَّنَّكُم مِّنَّا عَذَابٌ أَلِيمٌ . قَالُوا طَائِرُكُمْ مَعَكُمْ أَئِن ذُكِّرْتُم بَلْ أَنتُمْ قَوْمٌ مُّسْرِفُونَ﴾

অনুবাদ: “তারা বলল, ‘আমরা তো তোমাদেরকে অশুভ মনে করি; যদি তোমরা বিরত না হও, তবে আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে পাথর মারব এবং আমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের উপর বেদনাদায়ক শাস্তি আপতিত হবে।’ তারা [রাসূলগণ] বললেন, ‘তোমাদের অশুভ তোমাদের সাথেই আছে। এটা কি এই কারণে যে, তোমাদেরকে উপদেশ দেওয়া হয়েছে? বরং তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।'”

তাফসীর: সংঘাত আরও তীব্র হয়, যখন লোকেরা মৌখিক অস্বীকার থেকে সহিংসতার হুমকির দিকে অগ্রসর হয়। তাদের এই দাবি “ إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ ” (আমরা তোমাদেরকে অশুভ মনে করি) একটি কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতা প্রকাশ করে, যা সম্প্রদায়ের উপর আসা যেকোনো দুর্ভাগ্যকে রাসূলদের উপর চাপিয়ে দেয়। এটা প্রাক-ইসলামী সমাজে একটি সাধারণ প্রথা ছিল, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সামাজিক সমস্যাগুলোকে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করা ব্যক্তিদের উপস্থিতির কারণে হয়েছে বলে মনে করা হতো।

হুমকিটি দ্বিগুণ ছিল: পাথর নিক্ষেপ (rajm), যা ছিল প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার একটি পদ্ধতি, এবং একটি অনির্দিষ্ট “বেদনাদায়ক শাস্তি”, যা যেকোনো উপায়ে রাসূলদের নীরব করে দেওয়ার তাদের সংকল্প নির্দেশ করে।

রাসূলগণের উত্তর ছিল গভীর এবং তাদের কুসংস্কারের মূলে আঘাত হানে: “তোমাদের অশুভ তোমাদের সাথেই আছে।” এই উক্তিটি তাদের চিন্তাভাবনার মিথ্যা কার্যকারিতাকে চ্যালেঞ্জ করে, স্পষ্ট করে যে তারা যে কোনো দুর্ভাগ্য অনুভব করে, তা তাদের নিজেদের কর্ম এবং হেদায়েত প্রত্যাখ্যানের ফল, রাসূলদের উপস্থিতির কারণে নয়। “এটা কি এই কারণে যে, তোমাদেরকে উপদেশ দেওয়া হয়েছে?” এই বাক্যাংশটি উপকারী উপদেশের প্রতি শত্রুতা দেখিয়ে প্রতিক্রিয়া জানানোর অযৌক্তিকতাকে তুলে ধরে। রাসূলগণ এই কথা বলে উপসংহার টেনেছেন যে, আসল সমস্যাটি হলো: “তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়” (قَوْمٌ مُّسْرِفُونَ)—একটি সম্প্রদায়, যারা অবিশ্বাস ও নিপীড়নে সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart